কেকা অধিকারী
একদিনের জন্য বান্দুরা গিয়েছিলাম। ২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে। অনেক হুলুস্থুল ছিল। সকালে রওনা করে ঘন্টা তিনেক থেকে আবার ঢাকার পথ ধরেছি। বাসায় আসতে আসতে রাত আটটা বেজেছে। তবুও যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। না গেলে মনটা সুস্থির থাকতো না।
রাহুতআটি গ্রাম, বান্দুরা, নবাবগঞ্জ। আমার শেফালি মাসীর বাড়ি। মাসী তাঁর ছোট ছেলে দেবুকে নিয়ে সেখানেই থাকে। প্রবাসী কর্মজীবনের পাট চুকিয়ে মেসোও এ বাড়িতেই থেকেছেন। ৪ বছর হলো তিনি পরলোকবাসী।
বাড়ি আসছি তাঁকে দেখতে এ কথা তাঁকে আগে জানাইনি। কারণ মাসিও তো আর আগের মতন নেই। শরীরের বল নেই, নেই লোকবলও। বাজারের হোটেল থেকে পরোটা, ডিমভাজী, ডাল আর টুকটাক নিয়ে আমরা, আমি আর প্রদীপ, যখন ঘরের কাছে এলাম দেখা হলো ভাই দেবুর সাথে। ও বাইরে যাচ্ছিল। কী নাকি এক জরুরি কাজ আছে । দেবু চিৎকার করে বলল, “মা, গেট খোল।”
বেঁকে যাওয়া শরীরটায় প্রাণপণে গতি এনে মাসী চাবি হাতে কলাপসিবল গেটের কাছে আসতে আসতে জানতে চাইল কে আমরা। মাসী যখন বুঝতে পারল গেটে বাইরে আমি তখন তাঁর কান্না হাসি মনের কথা মিলেমিশে একাকার। এই মুহূর্তে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম আমার হুট করে চলে আসার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল।
প্রদীপ আর আমি এসেছি। অন্বয়ের পরীক্ষা আছে আগামী সপ্তায়। তাই ও এলো না। খুব পড়ুয়া ছেলে সে নয়। আসলে আগে থেকে তার প্রোগ্রাম ঠিক করা আছে বন্ধুদের নিয়ে। আমার মাসীকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা তো হঠাৎ করে করা। তবুও মনে হয় মানুষ যদি তার জন্ম পরবর্তী অসহায়কালটা স্মরণে রাখতে পেতো, তাহলে হয়তো অনেক ভালো হতো। হয় তো পৃথিবীর চেহারাটা ভিন্ন হতো। বয়স্কজনেরা সবার প্রায়োরিটি হতেন।
আমাদের পৌঁছাতে প্রায় দুপুর বারোটা বেজে গেছে। মাসি বারবার বলছিল-
– কেউ আর আসবে না ভেবে আমি কম্বলগুলো আজই তুলে রাখলাম।
আমি জানি আমরা আসব ভেবেই মাসী কম্বল বের করেছিল। এখন তাঁর মাথায় কম্বল নামানোর চিন্তা। আমি একটা রাত এখানে তাঁর সাথে থাকব না এখন সেটা সে ভাবছেই না।
– মাসী, প্রদীপের রাতে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তাই আমাদের একটু পরেই চলে যেতে হবে। কম্বল নামাতে হবে না।
– একটা রাত থাকবি না! কত কথা ছিল…
তিনি আর অনুরোধ করলেন না, জানেনই তো তার এ মেয়েটা অনেক বেশি বাস্তববাদী। পরিকল্পনা বদলানো যাবে না।
একটু পর মাসী ফ্রিজ থেকে একটা কেক নিয়ে এলো। “আমার নাতি জন্য রাখছি।” সাথে তেলে ভাজা নারকেল দেয়া আর নারকেল ছাড়া কুলি পিঠা ভরা দুটো পলিথিন ব্যাগ। সাথে অনুযোগ
– ঢাকায় যাবার সময় বাবুকে বলেছিলাম একটু নিয়ে যা। নিল না।
বাবু মাসীর বড় ছেলে। ঢাকায় আমরা পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে থাকি।
পরোটা ডিম দিয়ে আমরা নাস্তা সারলাম। মাসী খেতে চাইছিল না। আমি মুখে তুলে খাওয়ালাম একটু। এ সব আদিখ্যেতা আমার আসে না। তবুও করলাম। কেন করলাম? শুধু ভয় হয়, আর যদি দেখা না হয়!
মাসীর ফ্লাস্কের চা খেলাম। দুপুরে মাসী আজ নব বর্ষ উপলক্ষ্যে রান্না করা গতকালের বাসী পোলাও আর মাংস খাবে। আমরাও সেটাই খাব বললে মাসীর ভালো লাগলো না। নতুন করে সব রাঁধতে চাইল। বুঝিয়ে থামালাম। ফ্রিজে কিছু টাটকিনা মাছ কাটাবাছা ছিল। মাসী সেগুলো ভাজতে গেল।
আর আমি ভাবছিলাম সেই দিনগুলোর কথা যখন আমরা এ বাড়িতে বেড়াতে এলে প্রতি বেলায় মাছ মাংস পিঠার নতুন নতুন পদ খেয়েছি। কী বিশাল আয়োজন! মাসীর সব প্ল্যান করা থাকতো। বাড়িতে সাহায্য করার একাধিক মানুষ ছিলো। মাসী ছুটোছুটি করে শুধু তাদেরকে তদারক করতো। আমাদের ছোট গোল্লা, বড় গোল্লা, নয়নশ্রী, হাসনাবাদসহ নানান গ্রামে ঘোরানোর আয়োজনও করত। আমি চিল্লাচিল্লি করতাম,
– আমি অনেক টায়ার্ড। গ্রাম, গঞ্জ ঘুরতে, আত্মীয় স্বজন দেখতে আসিনি। আমি একটু নিরিবিলিতে রেস্ট নিতে আসছি।
মনে পড়ে মাসী একবার আমি মাঠ জমি দেখবো বলে মেসোকে দিয়ে আমাকে আর মাকে ব্রিজের ওপারের মাঠে পাঠিয়েছিল। সেবারই আমরা হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে গিয়েছিলাম। চকে গিয়ে সর্ষে ক্ষেতে ছবি তুলেছি।
মাসীকে চুলার কাছে পাঠাতে মন চাইছিল না। কিন্তু ওটুকু না করতে দিলে সে মেয়ে জামাইকে খেতে দিতে অস্বস্তি বোধ করতো।
মাসি মাছ ভাজার ফাঁকে আমরা মাসির শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছোট পিসির সাথে দেখা করে এলাম। পিঠার সাথে বৃষ্টি কাকির বানানো চা খেয়ে এলাম। মাসীর বেয়াইন জাসিন্তা মাসীমার সাথে দেখা করে এলাম।
ফিরে আমি আর প্রদীপ ভাত খেতে বসলাম। মাসী আমাদের সাথে বসল না। পরে খাবে, আমাদের বিদায় দিয়ে। দেবু প্রদীপকে নিজের কিছু কথা বলার জন্য ওর রুমে নিয়ে গেল। আমি আর মাসী এসে সামনের সিঁড়িতে বসলাম। আমরা যেখানে বসেছি ঠিক তার সামনের উঠোনে ক’বছর আগে আমি, মা, মাসী, মেসো মোড়ায় বসে গল্প করেছিলাম। আমার মোবাইলে সে সময়ের বেশ কিছু ছবি তোলা আছে। আজ মেসো নেই। আমি মাসীকে নিয়ে সেলফি তুললাম। মাসী ছবি তুলতে চাইছিল না। আমার মাসী আগের চেয়ে কত বদলে গেছে। কত ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে তার চেহারা! তবুও ছবি থাক, যদি আর এভাবে ছবি তোলার সুযোগ না আসে? আমার শুধু ভয় করে। মনটা হুহু করে।
সময় শেষ হয়ে এলো। রওনা দিলাম আমরা। মাসীকে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। পাশের বাড়িটা ভাই বাবুর শ্বশুর বাড়ি। ওর স্ত্রী, আমার প্রিয় ভাই-বৌ ন্যান্সী আমাদেরকে সামনের রাস্তায় ইজিবাইকে তুলে দিতে এলো।
আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, দূরে মাসী দাঁড়ানো। বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে আমাকে বিদায় জানানোর জন্য এসেছে। এবার যেখানে দাঁড়িয়ে ন্যান্সী আমাদের বিদায় জানালো গতবার মাসী ঠিক সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানিয়েছিল। এবার আর এটুকু পথ আসতে পারেনি। মানে মাসীর শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আমার মনটা মোচড় দিয়ে উঠল।
আমি পিছনে ফিরে দৌঁড়ে গিয়ে মাসীকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলাম। যদি আর না পারি এভাবে জড়িয়ে ধরতে! আর যদি সুযোগ না হয়!
পৃথিবী থেকে কে কার আগে বিদায় নিবে তার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। মাসীর চেয়ে আমিও আগে যেতে পারি। যে-ই আগে যাই, সেটাই হবে বিচ্ছেদ। বিশ্বাসের নিরীখে অনন্ত কিম্বা সাময়িক। আমি আবার রাস্তায় ফিরে গেলাম। মোবাইল বের করে দূরে দাঁড়ানো মাসীর একটা ছবি নিলাম। মাসীর মুখ দেখতে পাই না। শুধু অবয়বটার ছবি ধরি।
আহা, আমার মাসী! আমার শেফালি মাসী, যাঁর জীবন আমার কাছে বিষ্ময়কর গল্প, যাঁর ভালোবাসা আমার এক সময়ে ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে চাকরি করতে পারার অন্যতম নির্ভরতা।
ইশ্ ঈশ্বর, তুমি যদি মাসীর বার্ধক্যের কষ্টটা আরেকটু কমিয়ে দিতে, কিম্বা আমাকে যদি ক্ষমতা দিতে মাসী যেমন আমার অন্বয়কে যত্নে রাখতো আমি তাকে তেমন যত্নে রাখতে পারতাম, তাহলে আমি তোমার কাছে বড্ড কৃতজ্ঞ হতাম। ভীষণ ভালো লাগতো।
হুট করে মাসীকে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার সঠিক ছিল।