\
নির্বাচনী পথ এখনো বন্ধুর, ইসির রোডম্যাপ ঘোষণা
দিন যত যাচ্ছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জটিলতা ততই প্রকট হয়ে উঠছে। নির্বাচন-সম্পর্কিত মূল প্রশ্নগুলো—বিশেষ করে নির্বাচনী পদ্ধতি—এখনো অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। সরাসরি ভোটে নির্বাচন হবে নাকি চালু হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি, এই দ্বিধা একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে। পাশাপাশি এখনো ঘোষিত হয়নি আলোচিত জুলাই সনদ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই সনদ এবং নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারা সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গতকাল বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এতে মোট ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, রাজনৈতিক দল ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন ইত্যাদি।
রোডম্যাপে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, বাজেট, প্রচার, আইটি প্রস্তুতি, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকসহ নির্বাচন আয়োজনের প্রায় সব প্রস্তুতি এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসির ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচন তফসিল প্রকাশ এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
🟩 বিএনপি: “রোডম্যাপ আশাব্যঞ্জক”
বিএনপি রোডম্যাপকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ইসির প্রস্তুতি দেখে নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ছে বলে তারা আশাবাদী। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী একে ‘সুসংবাদ’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
🟥 জামায়াতে ইসলামী: “রোডম্যাপ বিভ্রান্তিমূলক”
অন্যদিকে, জামায়াত এই রোডম্যাপকে ‘গতানুগতিক ও বিভ্রান্তিমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার অভিযোগ করেছেন, জুলাই বিপ্লবের চেতনা উপেক্ষা করে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে।
🟥 ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: “পুরোনো বন্দোবস্ত জিইয়ে রাখার চেষ্টা”
দলটির মুখপাত্র মাওলানা আতাউর রহমান বলেন, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট ও স্বৈরতান্ত্রিক বাস্তবতা বিরাজ করছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই রোডম্যাপ গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে না। বরং এটি পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামো ধরে রাখার প্রয়াস।
🟨 এনসিপি: “সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রোডম্যাপকে সরাসরি সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল বলেছে।
🟩 আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি: “ইসির উদ্যোগ ইতিবাচক, তবে উদ্বেগ রয়েই গেছে”
এবি পার্টির শীর্ষ নেতারা রোডম্যাপ ঘোষণাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেও বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়ে গেছে।
⚖️ বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রোডম্যাপ ঘোষণাকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটি আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে, তবে এটি মূল সংকটগুলো—বিশেষ করে নির্বাচনী পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট তারিখ—সমাধান করেনি। এ অবস্থায় শুধুমাত্র ইসির একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, রোডম্যাপ কার্যকর হতে হলে প্রথমে নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুবা, এটি শুধু কাগুজে পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মন্তব্য করেন, “পুরোনো পথে হাঁটলে নতুন গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বার্থপরতা ছাড়িয়ে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।”
🧭 সামনে কী চ্যালেঞ্জ?
- নির্বাচনী পদ্ধতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (সরাসরি ভোট না পিআর পদ্ধতি?)
- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন
- রাজনৈতিক সংলাপ ও আস্থা ফিরিয়ে আনা
- নিরপেক্ষ প্রশাসন ও নিরাপত্তা পরিবেশ নিশ্চিত করা
- প্রতিটি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
সারসংক্ষেপে, রোডম্যাপ একটি কাঠামো দিয়েছে ঠিকই, তবে এটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঐকমত্য, আইনি ভিত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের ওপর। যদি এই মৌলিক সংকটগুলোর দ্রুত সমাধান না হয়, তবে আগত নির্বাচন নিয়েও জনগণের সংশয় কাটবে না।