রবিবার, সকাল ৬:৫৩, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার, সকাল ৬:৫৩, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ক্ষমা ও অতঃপর


-কেকা অধিকারী

১.
কী কারণে একজন মানুষকে ভালো লেগে গেল বা তার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হলো তার কারণ নিয়ে সম্পর্কে
জড়ানোর আগেই গভীর ভাবে ভাবা প্রয়োজন। এই ভাবনাটা যে কতো জরুরী সেটা ঝিরি উপলব্ধি করেছে অনেক
পরে। তাই ভালো লাগা বা ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টির কারণ বিশ্লেষণে না গিয়েই এক ছাত্র সম্মেলনে বাবনদার
মুখে চে’ গুয়েভারার জীবন-দর্শন শুনে চে’কে তার প্রচন্ড ভালো লেগে যায়। পরে মানুষটির বহুবার দেখা ছবিটি সে
আরেকবার মনোযোগ দিয়ে দেখে। হাতে মোটা চুরুট, মাথায় অন্যরকম টুপি। তার চোখ দিয়ে ভালোবাসার কথা যেন
ঠিকরে বের হচ্ছে! সাদা কালো ছবির মানুষটির সম্পূর্ণ অবয়বের যে দিকটি তাকে টানলো তা হচ্ছে তাঁর পাতলা
অথচ সুন্দর করে ছাঁটা দাড়ি। অবশ্য সেটা যে কোন দাড়িওয়ালার প্রতি সদ্য তরুণীটির প্রথম প্রেম ছিল তা নয়।
ঝিরির বাবার বিরাট স্টাডি রুমের বই ভর্তি কাঠের আলমারীগুলির ফাঁকে ফাঁকে দেয়ালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ,
রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইন, বেগম রোকেয়া, স্বামী বিবেকানন্দ, যিশুসহ অনেক
বিখ্যাত ব্যক্তির ছোট বড় ছবি টানানো ছিল। যিশু খ্রিস্ট! কি সুন্দর শান্ত সৌম্য বিষাদ-মাখা চেহারা! মায়াময়
মুখটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তিরিশোর্ধ এই দাড়িওয়ালা তরুণকে যে কখন ভালোবেসে ফেলেছিল ঝিরি তা সে
নিজেও জানে না!
এক সাথে একাধিক ব্যক্তিকে ভালোবাসা অনৈতিক। তবুও প্রথম যৌবনে একদিন ‘আমারও পরান যাহা চায়’
গানটি তার খুব ভালো লেগে যায়। গানের রচয়িতা ঋষির মতো রবিঠাকুরকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলে সে।
এরপরেও তার ভালোবাসা দেয়া-নেয়ার চাহিদারেখা ক্রমাগত উর্ধমূখী হতে থাকে। ঝিরি ‘জীবন ও মরণের সীমানা’
ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বন্ধুর প্রয়োজন অনুভব করে যার ভালোবাসায় আবদ্ধ থেকেও সে থাকবে সম্পূর্ণ
স্বাধীন!
স্বপ্নের মানুষটির কত যে ছবি মনে মনে আঁকতো ঝিরি! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে স্বপ্নে বা কল্পনায় দেখা তার
ভালোবাসার মানুষটির মুখ সব সময়ই শশ্রুমন্ডিত। রাত-দিন মাথায় একটাই চিন্তা – কার্ল মার্কস, রুদ্র
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আসাদুজ্জামান নূর, এন্ড্রু কিশোর – এদের কার মতো হবে তার সেই
প্রেমিক পুরুষ?

২.

ঝিরি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ক্লাশের ফাঁকে মলচত্বরে বসে একদিন আড্ডা দিচ্ছিল বন্ধুরা মিলে।
হঠাৎ দূরে বসা একটি ছেলেকে দেখে চমকে ওঠে সে। ওর অপলক দৃষ্টি অনুসরণ করে বান্ধবী রুম্পা বলল,
‘ছেলেটা দেখতে একটু অন্যরকম, না রে? দাড়িটায় ভীষণ মানিয়েছ।’

সম্পর্ক হতে বেশি সময় নিল না। স্থায়ী সম্পর্ক রচনায় আপাত জটিল অসম্ভব বিষয়গুলি ওর মুগ্ধ দৃষ্টি ও
বিশ্বাসকে আড়াল করতে ব্যর্থ হল। চে, যীশু, রবি অথবা এমনতর আরো অনেকের অতিমানবীয় চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সাথে শুভর চেহারার সাদৃশ্য ঝিরিকে ভালোবাসার এক ছোট্ট গৃহকোণের স্বপ্ন দেখতে
প্ররোচিত করলো। বেঁকে বসা অভিভাবকদের সামনে নিজের বিশ্বাস প্রমাণ করতে ঝিরি তখন মরিয়া। সে শুভকে
বিয়ে করল।

সারা জীবনের ব্যাপ্তির তুলনায় চার বছর নিতান্তই ক’টা দিন। এই অল্প সময়েই ঝিরি দ্বিধাগ্রস্ত। দু’চোখের
স্বপ্ন ফিকে হতে হতে বিবর্ণ হয়ে গেল। কষ্টে গড়া সংসারে কোন অভাব ছিল না তার। স্বর্গের দেবশিশুটি
চাইলেই নেমে আসতে পারতো তাদের ঘরে। স্মার্ট শুভর মুখেও ছিল ঘন কালো দাড়ি, ছিল তার মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানীর দামী চাকুরী। সংসারে বেশি সময় দেবে বলে ঝিরি শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছে। নামকরা স্কুলে সবার
পছন্দের টিচার সে। তারপরেও ভালোবাসা তাদের ঘরের জানালা দিয়ে পালাতে চাইছে। কিম্বা এরই মধ্যে দু’চারটি
শুভ্র পালক ফেলে রেখে তার ভালোবাসার মরাল উড়াল দিয়েছে। উচ্ছিষ্ট প্রেমের ক্ষীণস্রোতধারায় অশান্তির
আগুন নিভল না। শুভর তপ্ত বাক্য ড্রিল মেশিন হয়ে ঝিরির হৃদয় একের পর এক ছিদ্র করে চলল। মান-অভিমান,
কথাবন্ধ পর্ব আগেই শেষ হয়েছে। তার স্থান দখল করেছে উচ্চস্বরের ঝগড়া। প্রায়শই আগুনের উত্তাপ,
সর্বগ্রাসী শিখা, ড্রিল মেশিনের কর্ণবিদারী শব্দ ঘরের দেয়ালের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও পৌঁছায়। বাকীটা সময়
ঘরের হওয়ায় ভাসে কবরের নৈঃশব্দ।

সেদিন পাশের ফ্ল্যাটের চাচী বলছিলেন, ‘তোমরা দু’জনেই তো কত লেখাপড়া করেছো, শুভ কত ভাল চাকরি করে,
তুমিও স্কুলে ছেলেমেয়েদের কত কিছু শেখাও। ঘরটাকে কত সুন্দর করে সাজিয়েছ। ঘরে-বাইরে নানা কাজ কত
সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করছ দু’জনে মিলে। এত অল্প বয়সে ক’জনে এমন পারে, বলতো? তারপরেও যে, মাঝে মাঝে
তোমাদের কী হয়!’ চাচীর কথায় ঝিরি অপমানে কুঁকড়ে যায়। অনেকের প্রশংসা পেলেও শুভ কোনদিন এভাবে ঝিরির
পরিশ্রম দেখেনি, সংসারের প্রতি তার আন্তরিকতাও শুভর চোখে গুরুত্বহীন। ঝিরির কাজে কোন না কোন দোষ
তার চোখে ধরা পরবেই। ফলে স্বপ্ন থেকে বাস্তবের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলে। সংসার নয়, বাইরের জগতই
বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে ঝিরির কাছে।

এক পর্যায়ে সংসারের নৈমিত্তিক অশান্তি গায়ে হাত তোলাতে এসে পৌঁছায়। সে নির্মমতার সাক্ষী হয় ঘরের
দেয়াল, আসবাবপত্র এবং সাহায্যকারী মেয়েটি। কিন্তু যেদিন শুভর ঐ সুন্দর মুখ উচ্চারণ করে, ‘মাগী, এত হাসি,
এত কাব্য? বন্ধু, ক্লাশমেট আর কলিগ বুঝাস আমারে? এত স্বাধীনতা! ওরা তোরে কিছু না করে এমনি এমনি
ছাড়ে? ঢেড় হইছে। এবার সব ছাড়বি, নতুবা ঘর।’ ঝিরি ঘর ছাড়ে।

দাড়িওয়ালা পুরুষেরা কেবল ভালোবাসা নয়, কেউ কেউ ভ্রমও ছড়ায়! শুভ শেষোক্তদের দলে। ঝিরির পায়ের নিচের
মাটি সরে গেছে। কোথায়ও বিরাট ভুল হয়েছে। মনের মধ্যে চলমান বিশ্লেষণগুলি তাকে পাগল করে দিচ্ছে। কোন
বইতে তো সে পড়েনি কিম্বা কোন জ্ঞানীজনও তো তাকে কোনদিন বলেননি যে, দাড়িওয়ালা মানুষ মাত্রই
স্বর্গীয় প্রেম বিতরণ করেন। কোন যুক্তিতেই কথাটা গ্রহনযোগ্য নয়। তাহলে? বাবার লাইব্রেরির দেয়ালে
টানানো দাড়িওয়ালা মহামানবদের মুখমন্ডলের দৃষ্টিগোচর সাদৃশ কি তার সামনে অলীক প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে
নি? উদার প্রেমিক বলতে তার মাথায় দাড়িওয়ালা পুরুষের ছবি কি তাঁরাই এঁকে দেননি?।
কি করবে এখন ঝিরি? কে প্রতারণা করল তার সাথে? শুভ তো একা নয়! চরম আক্রোশে হাপর-বুকের উত্তপ্ত
বাতাস শূন্যে ছড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসা-ছড়ানো দাড়িওয়ালা পুরুষদের প্রতি নিঃশব্দ হুংকার ছাড়ে সে, ‘আমি তোমাদের
একজনকেও ছাড়বো না। একটি একটি করে আমি তোমাদের সবকটি দাড়ি উপরে ফেলবো। নতুবা নরসুন্দরের ক্ষুরে
তোমাদের ঐ বিভ্রান্তিসৃষ্টিকারী সৌন্দর্য নিশ্চিহ্ন করবো। তোমাদের অঙ্গহানী ঘটবে না সত্য, কিন্তু তোমরা
কুৎসিত দর্শন হবে, ভালোবাসায় সমর্পিত নারীর মুগ্ধদৃষ্টি হারাবে।’

তার যাবতীয় হুঙ্কার মৌনতায় আবদ্ধ থাকে। কিছু করা হয়ে ওঠে না । ক্ষোভ, ক্রোধ, অপমান আর
সত্যোপোলদ্ধি মিলেমিশে তার মস্তিস্কে ভূমিকম্প ঘটায়। চিন্তাভাবনা ধ্বসে পড়ে। অস্থিরতা পেয়ে বসে তাকে।
নিজের উপর রাগ পুঞ্জিভূত হয় তার। এক গাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললে হাসপাতালে নিয়ে স্টমাকওয়াশের পরে
কিছুটা সুস্থ হয় সে। পরে তাকে যেতে হয় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।

ড: আনোয়ারার চিকিৎসা আর মা-বাবার ভালোবাসা বাঁচিয়ে তোলে তাকে। ‘মানুষই তো ভুল করে। তাই বলে অতোটা
বোকা হতে আছে?’ ড: হকের কথায় নিজেকে ফিরে পায় ঝিরি। মায়ের চূড়ান্ত বিরোধীতার বিরুদ্ধে গিয়ে শুধুমাত্র
তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাবা তাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেনে। সেই বাবাই ঝিরিকে বলেছেন, ‘জীবন
অমূল্য। সামনে অনেক দিন পরে আছে। নতুন করে বাঁচতে চেষ্টা করো। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই।” চে’র একটি
কথা মনে পড়ে তার – ‘মূলতঃ মুক্তিদাতার কোন অস্তিত্ব নেই, মানুষ নিজেরাই পারে নিজেদের মুক্ত করতে।’
নিজেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্তটি এবার তাকেই নিতে হবে। সে নিজেই শুভ তথা সব ভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর প্রতারক-
ভালোবাসায় দাড়ি টানবে। শুভর ঠিকানায় ঝিরি তালাকের নোটিশ পৌঁছে যায়।

৩.
বাবার বাড়ির নিজের বিছানায় শুয়েছিল ঝিরি। ছেঁড়া ঘুম আর বিক্ষিপ্ত ভাবনায় কখন যে সকাল সাড়ে ৯টা বেজে
গেছে খেয়াল করেনি ও। খেয়াল হল যখন দরজায় শব্দ শুনল। বাবা-মা দু’জনেই সেখানে দাঁড়িয়ে। মা ইতঃস্তত করে
বললেন, ‘শুভ ওর মা, বড় বোন আর চাচাকে নিয়ে এসেছে। তোর সাথে মিটমাট করে ফেলতে চায়।’

বাবা কী বুঝলেন কে জানে? নিষ্পলক চেয়ে থাকা ঝিরিকে বললেন, ‘যাও, কী বলে শোন। তবে সিদ্ধান্ত দেবার
আগে ভেবে দেখার সময় নিও।’
ঝিরির সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাবা কোন মন্তব্য করলেন না। তবে মায়ের সুখিভাব প্রকাশ পেল তার কথায়, ‘মেয়েদের
জীবনে বিয়ে একবারই হয়। তাছাড়া কোন্ সংসারে না অমন একটু আধটু হয়? তাই বলে কী মেয়েরা স্বামীর ঘর করে
না?’ ঝিরি ‘স্বামীর ঘর’ করার জন্যে তালাক উঠিয়ে নিল।

প্রায় পাঁচ মাস পরে পুরনো ঘরে ফিরল ও । ঘরটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। সব কিছু তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে যাচ্ছে! শুভ
একেবারে ভিন্ন মানুষ, ঠিক তার স্বপ্নের মতো। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে, কেন সে চলে গিয়েছিল? কেন এমন
নাটক করল? আবার কখনো ভাবে, ‘ভালোই করেছি। অমন না করলে ও কোনদিনই আমার মূল্য বুঝতো না।’ ফিরে
আসার এগারো মাসের মাথায় শুভ ওকে অবাক করে দিয়ে কানাডার ভিসা লাগানো নিজের পাসপোর্টটি ওর সামনে
মেলে ধরল। অনেকদিন থেকেই নাকি চেষ্টা শুরু করছে। তিন মাসের মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে কানাডায় পাড়ি জমাল
শুভ। স্বামীর কাছে যাওয়া ঝিরির সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত হল না। কানাডা থেকে শুভ তাকে লিখল, ‘শোনো, মেয়েমানুষের এত দেমাগ ভাল না। তুমি
তালাক দেবে আমায়? এখন দেখ কে কাকে তালাক দেয়! খুব শীঘ্রি আমার দেয়া ডিভোর্স লেটারটি তোমার ঠিকানায়
পৌঁছে যাবে।’ দু’মাস পরে ডিভোর্স লেটারটি হাতে পেয়ে ঝিরি যখন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তখন তার গর্ভে এক নতুন
প্রাণের স্পন্দন।


এর পরের দিনগুলিতে ঝিরির বাবা আর বাবা থাকেননি শুধু। বন্ধু হয়ে তাকে যেন ধরে রেখেছিলেন প্রতিটি মুহূর্ত।
আগলে রেখেছিলেন যাবতীয় নেতিবাচক ভাবনা এবং প্রতিকূল পরিবেশ-পরিজন থেকে। আর তার স্পন্দন যেন
পেটের মধ্যে থেকেই বলতে শিখেছে ‘মা, আমি তো তোমার সাথেই আছি।’ তাই বুঝি ঝিরির পক্ষে যুদ্ধটা চালিয়ে
যাওয়া সহজ হয়েছে। দুধের বাচ্চা সামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমবিএ করা সম্ভব হয়েছে। মানসিক
জোরের কারণেই তার পক্ষে অসম্ভব হয়নি ব্যাংকের ভালো চাকরিটি জুটিয়ে ফেলা। তবে কাজগুলি করা যে
কতোটা কঠিন ছিল তা শুধু কাছের জনেরাই বুঝতে পেরেছেন।


আজ শুক্রবার। ভোরের আলোয় দিনমান ব্যস্ত রাস্তাটা দেখে ঝিরি। হাতে গোনা কয়েকটি রিক্সা ও গাড়ি চলছে
সেখানে। তার দৃষ্টি পৌঁছে যায় লম্বা রাস্তার শেষ প্রান্তের ফুলের দোকানটিতে। কর্মচারী ছেলেটা সিএনজি থেকে
ফুল নামাচ্ছে – লাল, সাদা, হলুদ, কমলা, বেগুনী, নানা রঙের ফুল। ঝিরির চোখে জল নেই এখন বরং সে আগের চেয়ে
স্পষ্ট দেখছে।

তার চোখে স্থান করে নিয়েছে স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস। স্বপ্ন তার সন্তান স্পন্দনকে ঘিরে। পরিবারের
সমর্থন আর ভালো চাকরী তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শক্তি যুগিয়েছে। ছয় বছর পূর্ণ করা ছেলেটি এখন ক্লাশ টুতে
পড়ছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও ঝিরিই স্পন্দনের পড়াশোনা দেখে। সাহায্যকারী মেয়েটি সকালের নাস্তা দিয়ে গেলে
ছেলেকে ঘুম থেকে জাগায় ও। নাস্তা খাইয়ে পড়তে বসায় তাকে।
-মা, আমার শব্দার্থ পড়া শেষ।
-তাহলে শব্দগুলি দিয়ে বাক্য রচনা কর।
লেখা শেষ করে স্পন্দন খাতাটা মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। খাতায় চোখ বুলায় ঝিরি-
-তুমি ভীষণ অমনোযোগী। একটা বাক্যের শেষেও দাড়ি দাও নি।
-দিয়েছি। ছেলের প্রত্যয়ী উত্তর।
-কোথায় দাড়ি দিয়েছো, দেখ তো?
ছেলের চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। ঝিরি তার কারণ বুঝতে চেয়ে ব্যর্থ হয়। ‘কোথায় দাড়ি?’
‘এই যে এখানে।’ ছেলে তার থুতুনী দেখায়। সেখানে বলপেনের কালির কতোগুলি কালো আঁচড়।
কেঁপে ওঠে সে। আবারও দাড়ি? ঝিরির মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। দেহের সমস্ত শক্তি আর মনের ক্ষোভ এসে জমা
হয় তার ডান হাতের পাঞ্জায়। সহসা হাতটি উঠে আসে ছেলের মুখের সমান্তরালে। চকিতে চোখ পড়ে ছেলের চোখে।
দুষ্টুমির হাসি মিলিয়ে গিয়ে প্রচন্ড ভয় ভর করেছে সে চাহনিতে। ঝিরি থমকায় একটু। বিদ্যুৎগতিতে তার সামনে
আসেন ক্রুশবিদ্ধ যীশু, শ্বেতাঙ্গ শোষককে ক্ষমা করে দেয়া ম্যান্ডেলা। মনে পড়ে যায় ছেলেকে নিয়ে তার সুন্দর
জীবনের স্বপ্নকে। মনে পড়ে শুভর মুখ আর নিজের কথা। কী যেন হয়ে যায় তার! ক্ষমা করে সে শুভকে, ক্ষমা করে
নিজেকে। উন্মত্ত হাতটি ছেলের গালে না পরে ঘুরে চলে যায় তার মাথার পিছনে। ছেলের মাথাটি সজোরে বুকে টেনে
নেয় ঝিরি, দু’হাতে তার নিষ্পাপ মুখটি তুলে ধরে থুতুনিতে কলমের কালিতে আঁকা রেখাগুলিতে চুমু দেয় সে গভীর
ভালোবাসায়। চোখ ভরে উঠে তার জলে। বহুদিন পরে নিজেকে নির্ভার লাগছে, মুক্ত মনে হচ্ছে।
ঝিরির বাবার বাড়ির দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি পরিবারের ছেলে মৈনাক। ঝিরি আজই মৈনাককে নিজের সিদ্ধান্তের
কথা জানাবে। আর ফিরিয়ে দেবে না ওকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top