শনিবার, রাত ১১:৩২, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শনিবার, রাত ১১:৩২, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিশ্বাসীর দুনিয়া ও উহার সীমারেখা ।

বিশ্বাসীর দুনিয়া ও উহার সীমারেখা ।

কতটুকু দুনিয়াদারী করা যাইতে পারে ইসলাম তাঁহার সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন “পানিতে হাত ডুবাইয়া উঠাইলে যেটুকু পানি স্বাভাবিকভাবে অনিচ্ছাসত্বেও হাতের সঙ্গে লাগিয়া আসিবে ঠিক সেইরূপ পার্থিব জীবন ধারণ করিতে গেলে যতটুকু ‘দুনিয়া’ অপরিত্যাজ্য বা স্বভাবতই মনের মধ্যে লাগিয়া থাকিবে, ততটুকু দুনিয়াদারী করা নির্দোষ। ইচ্ছা করিয়া ইহার অতিরিক্ত তুলিয়া লইলে উহাই দোষনীয়। এই পরিমাণ দুনিয়া মানুষের পার্থিব জীবনের ভিত্তি। ইহা ছাড়া মানুষ এই জীবনে বাঁচিতে পারে না। মুস্তাওরিদ-বিন-শাদ্দাদ হইতে বর্ণিত আছে, তিনি বলিয়াছেন, আমি রসুলে করিম (দঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি ঃ “কসম খােদার, দুনিয়া-আখেরাতের তেমনি যেমন কেহ আঙ্গুল ডুবায় সাগরে আর দেখে কতটা পানি আনিয়াছে উহা।” (মুসলিম)

জাবির হইতে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ (দঃ) চলিলেন একটি কানকাটা মরা ছাগলের বাচ্চার কাছ দিয়া। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমাদের কে চায় যে ইহা নিবে এক দিরহাম দিয়া?” তাঁহারা বলিল, “আমরা চাইনা ইহা নিতে কিছু দিয়া?” তিনি বলিলেন, “তবে কসম আল্লাহর, দুনিয়া আল্লাহ কাছে তুচ্ছতর– তােমাদের এই (ছাগ শিশু) অপেক্ষা।” (মুসলিম)

দুনিয়া ব্যতীত আল্লাহর দ্বীনের পরিচয় ও প্রকাশ অসম্ভব। যেমন অন্ধকার ও অন্যায়ের অস্তিত্ব ব্যতীত আলাে ও ন্যায়ের পরিচয় হয় না, সেইরুপ দুনিয়ার জীবন সৃষ্টি না করিলে আল্লাহর দ্বীনের জীবন উপলব্ধি করা সম্ভব হইত না। এইজন্য সাময়িক দুনিয়া সৃষ্টি করিয়া উহাকে মানুষের শিক্ষাক্ষেত্র তৈরী করিয়াছেন—এখানেই দ্বীনের অনুশীলন করিতে হইবে। দুনিয়াতে দ্বীন শিক্ষা করিবার সুযােগ গ্রহণ করার জন্যই উহার সৃষ্টি। দুনিয়াতে দুনিয়া শিক্ষা করিলে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। আপসােস আমরা শুধুই দুনিয়া শিক্ষা করিতে কত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ততােধিক আক্ষেপ এইজন্য যে, উহাতে আমরা অনুতপ্ত না হইয়া বরং দুনিয়া-ভিত্তিক শিক্ষা সমূহকেই আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে একমাত্র কল্যাণকর ব্যবস্থা মনে করিয়া লইতেছি। অথচ হাদিস আছে। “দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।”

কোরান মাজিদে আল্লাহতালা আমাদিগকে প্রার্থনা করিতে শিখাইতেছেন— “রাব্বানা আতেনা ফিদুনিয়া হাসানা অফিল আখেরাতে হাসানা” অর্থাৎ হেআমাদের রব আমাদিগকে দুনিয়াতে কল্যাণ ও সৌন্দর্য দান কর এবং আখেরাতে কল্যাণ ও সৌন্দর্যদান কর।

কোরানের এই কথা দ্বারা কেহ হয়ত প্রশ্ন করিবেন যে, দুনিয়াতে কল্যাণ কামনা করা আল্লাহতালাই শিখাইয়া দিয়াছেন। তাহা হইলে মােমিনের দুনিয়া ত্যাগ করার প্রশ্ন কেমন করিয়া আসিতে পারে ।

মানুষকে কিছুকাল দুনিয়ায় বাস করিতেই হয়, কারণ দুনিয়াতে তাহাকে পরীক্ষার জন্য সাময়িকভাবে স্থাপন করা হইয়া থাকে। কিন্তু পরপারের অনন্ত জীবনে উদ্ধার পাইতে চাহিলে দুনিয়া ত্যাগ করিয়া আল্লাহর দ্বীনে আশ্রয় লইবার চেষ্টা তাহাকে করিতেই হইবে। অবশ্য মৃত্যু পর্যন্ত কিছু না কিছু দুনিয়া তাঁহার পার্থিব জীবনে থাকিবেই যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাহাকে পরিপূর্ণভাবে আপন দ্বীনের মধ্যে গ্রহণ না করেন। অনিচ্ছাকৃত এই পরিমাণ দুনিয়া নিস্পাপ, কল্যাণকর ও সুন্দর।

উপরােক্ত প্রার্থনার মধ্যে আমাদের দুনিয়ায় যে কল্যাণ কামনা করা হইয়া থাকে তাহা ধনসম্পদের প্রাচুর্য নহে, বরং তাহা এমন পরিমাণ দুনিয়া যাহা কল্যাণ-মন্ডিত ও সুন্দর। সেখানে না আছে সৃষ্টির প্রতি কামনা-বাসনা না আছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রতি মনযোেগ বা আগ্রহ। আছে শুধু স্রষ্টার প্রতি আকৃষ্ট থাকিয়া তাঁহারই আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য দৃঢ় মনােবল লইয়া নিরলস জীবন যাপন করা।

ত্যাগ ও আত্মােৎসর্গের মধ্যে পরস্পর প্রেম-প্রীতির সহিত আল্লাহর সন্তোষ লাভের কর্মে যথাসম্ভব মশগুল থাকার মধ্যে যে পরিমাণ দুনিয়া স্বভাবতই রহিয়া যায় তাহার মধ্যে সৌন্দর্য ও কল্যাণ কামনার প্রার্থনা আল্লাহ শিখাইয়াছেন এই আয়াতে। এইরূপ নিয়ন্ত্রিত দুনিয়ায় যিনি বাস করেন দুনিয়া তাঁহার দাস, তিনি দুনিয়ার দাস নহেন।

সংযত ও সংহত থাকিয়া নফস হইতে দুনিয়াকে উচ্ছেদের কঠোর শাসনের পর অনিচ্ছাকৃত যে দুনিয়াটুকু নফসের সঙ্গে লাগিয়াই থাকিবে সেই পরিমাণ দুনিয়ার মধ্যে কল্যাণ ও সৌন্দর্য থাকে। উহাই মানবতার সীমা এবং উহাকেই “দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী বাঁধ” বলা হইয়াছে যাহা দুই সমুদ্রকে আলাদা করিয়া রাখিয়াছে। দুনিয়ায় সৌন্দর্য ও কল্যাণ লাভের জন্য যে প্রার্থনা, সেই দুনিয়া অবাধ ও অসংযত-দুনিয়া নয়, কারণ সেরূপ দুনিয়া নিজেই কল্যাণের আঁধার।

সংযত ও অনিচ্ছাকৃত দুনিয়ার মধ্যে আল্লাহর ‘সৌন্দর্য ও কল্যাণ’ বর্ষিত হইলে সেখানে বৈষয়িক প্রাচুর্য ও অপ্রাচুর্যে কিছু আসে যায় না, কারণ সৌন্দর্য মণ্ডিত হইলে সাংসারিক প্রাচুর্য থাকিলেও উহা ‘দুনিয়া’ নয়। ‘দুনিয়া’ আরােপিত হইলে অপ্রচুরতার মধ্যকার জীবন যাপনের সবটুকুও দুনিয়াই হইয়া থাকে। আবার প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করিলেও সংসার নির্লিপ্ত মনের নিকট উহা দুনিয়া নয় । ঠিক যেমন ‘তাগুত’। মন উহাকে আল্লাহর নিদর্শনে পরিণত করিতে পারিলে উহা আর তাগুত থাকে না। সকলই মনের শিক্ষার উপর নির্ভর করে।

এই প্রার্থনা মনের উপর আল্লাহর রহমত প্রার্থনা, যেন সৌন্দর্য ও কল্যাণ বর্ষিত হইয়া মন এমন ভাবধারা গ্রহণ করিতে পারে যেন, তাগুত পরিবেষ্টিত জীবন ধ্বসিয়া পড়ে এবং রহস্যের দ্বার উৎঘাটিত হইয়া বস্তু সমুদ্রের কঠিন আবরণ ভাঙ্গিয়া আল্লাহর জ্যোতি-সমুদ্র প্রকাশিত ও বিকশিত হয়। বাহ্যিক প্রাচুর্য বা অপ্রাচুর্য তখন একাকার।

দুনিয়াতে কল্যাণ কামনার এরূপ আর একটিও উক্তি কোরানুল করিমে কোথাও আছে বলিয়া মনে হয় না। অপরপক্ষে দুনিয়ার কদর্য স্বরূপ প্রকাশে কোরান সর্বত্রই মুখর হইয়া আছে। কোরান দুনিয়াকে এমনভাবে দোষারােপ করিয়াছে এবং দুনিয়ার জিন্দিগীর কদর্যরূপ এত বেশি প্রকাশ করিয়াছে যে, তাঁহার এই সুর প্রায় সর্বত্রই ঝংকৃত হইয়াছে।

নানারূপ তুলনা ও রূপক বর্ণনার সাহায্যে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী প্রলােভনের অসংখ্য ছবি আঁকিয়া দুনিয়ার এই কুৎসিত ও ধ্বংসাত্মক রূপটি বারবার বহুরূপে উল্লেখ করিয়া মানুষকে উহা হইতে সতর্ক হইয়া থাকিতে বলা হইয়াছে।।

মসজিদ দর্শন।

সদর উদ্দিন আহমদ চিশতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top