সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী
রুহ : ‘
সাধক নফস’ এর উপর মোহাম্মদী নূরের একটি বিকাশের অবতরণকে রুহ বলে। রুহ জাগ্রত হইয়া দৃশ্যমান হইলে তাহাকে হুর বলে। যখন সাধকের আপনরূপে মূর্তিমান হইয়া দৃশ্যমান হয় উহাই হুর নামে আখ্যায়িত। আপন আলোকিত মূর্তিকে হুর বলে।
‘হুর’ অর্থ আপন পরিশুদ্ধ ও আলোকিত রূপ। আপন জ্ঞানময় সত্তাকে হুর বলে। হুর চক্ষু বিশিষ্ট অর্থাৎ জ্ঞানী। আপন জ্ঞানময় সত্তা দর্শনকে হুর দর্শন বলে। হুর-দর্শন আত্মদর্শনের নামান্তর। এই হুর প্রত্যেকের মধ্যে লুকাইয়া আছে। সাধনা দ্বারা ইহার সংগে মিলন ঘটে। হুরপ্রাপ্ত ব্যক্তির হুর অন্য সবার জন্য দৃশ্যমান নয়।বাংলার স্বভাব কবি ফকির লালন শাহ রুহকে ‘অচিন পাখী’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। *তাহারা বিছানার উপরে (অর্থাৎ দেহের উপরে) হেলান দিয়ে থাকে, ইহার অসীম বাতেন অংশ রেশম দ্বারা খোচিত। এবং (এই) দুই জান্নাতের ফল সংগ্রহ নিকটবর্তী (একটি অবস্থানে থাকে) (৫৫:৫৪) ব্যাখ্যা : তাঁহারা এমন বিছানার উপরে অর্থাৎ দেহের উপরে হেলান দেয় অর্থাৎ নির্ভর করে, যাহার অসীম বাতেন অংশ, অর্থাৎ অদৃশ্য অংশ পরম সৌন্দর্যে ভরপুর। দেহের উপরে হেলান দেওয়া অর্থঃ দেহকে অবলমম্বনরূপে গ্রহণ করা। যেরূপ দেহ অসীম বাতেনী সৌন্দর্যে ভরপুর তাহাই তাঁহাদের আশ্রয়স্থল। দেহকে বিছনার সঙ্গে তুলনা করিবার কারণে বিছানার নীচে অসীমভাবে লুক্কায়িত রেশমের কারুকার্যের উল্লেখ করা হইয়াছে। আসলে ইহা মানব অন্তরে লুক্কায়িত অসীম সৌন্দর্যবোধ, এবং ইহা দেহের বাহিরে প্রকাশিত থাকে না। তাঁহাদের দেহের বাতেন অংশে অনেক সৌন্দর্য গোপন রহিয়াছে। *ইহাদের মধ্যে রহিয়াছে চোখের দৃষ্টি সংযতকারী, যাহাদিগের সংস্পর্শে আসে নাই ইতিপূর্বে কোন মানুষ এবং না কোন জিন।(৫৫:৫৬) ব্যাখ্যা : “কাসেরাতু তরফে” চোখের দৃষ্টি বিষয়ে যে নিজেকে সংযত রাখে। জান্নাতবাসীগণ সকলেই স্ত্রীলিঙ্গ এবং প্রকৃতি। যদিও ইহারা উচ্চতম জাহান্নামের অধিবাসী তথাপি ইহারা এখনও পুরুষ হয় নাই, প্রকৃতির মধ্যে আবদ্ধ আছেন। সেইজন্য স্ত্রীলিঙ্গ প্রয়োগ করা হইয়াছে। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হইল চোখ। মোহমাখা চোখ যারা সংযত করিতে পারিয়াছেন তাঁহারাই কামিয়াব হইয়া থাকেন। উচ্চতম জান্নাতবাসীগণ চোখের সংযম এমনভাবে আয়ত্ত করিয়া থাকেন যাহা অন্য কোন পর্যায়ভুক্ত জিন অথবা ইনসান আয়ত্ত করিতে পারে নাই। সুতরাং জনগণ এই পর্যায়ের মানুষের সংস্পর্শে আসিবার অযোগ্য। তাঁহাদের মধ্যে রহিয়াছেন আনত দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, যাহাদের দৃষ্টি বহির্মুখী না হইয়া অন্তর্মুখী হইয়াছে, সুতরাং তাহারা আত্মদর্শনে পরিপক্ক। হুর : তাঁবুর মধ্যে আবদ্ধ (বা আবৃত)আছেন। অথবা—বাড়ির প্রধান হুর তাঁবুর মধ্যে গোপন রহিয়াছেন। (৫৫:৭২) ব্যাখ্যা : “মাক্সুরাতুন” অর্থ বাড়ির প্রধান; আবদ্ধ; প্রাসাদে আবদ্ধ মহিলা; গোপনীয় মহিলা। রুহ আল্লাহ্র জাতি নূর। নূরে মোহাম্মদী’র একচ্ছটা আলো প্রত্যেক মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া বিরাজ করেন তখন উহাকে হুর বলে। হুরের চেহারা মানুষের আপন আলোকিত সুক্ষ্ম চেহারা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। ইহাই আত্মদর্শনের চরম পর্যায়। আপন প্রচ্ছন্ন হুরের সঙ্গে মিলনের মধ্যেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা। মানবদেহ আল্লাহ্’র ঘর বা প্রাসাদ। এই প্রাসাদের গোপন রানী হইয়া হুর বিরাজ করিতেছেন। হুর স্ত্রীলিঙ্গে প্রকাশিত। এইজন্য সূফী সাধকগণ তাহাদের মাশুককে প্রেয়সী, রানী ইত্যাদি নামে সম্বোধন করিয়া থাকেন। *তাঁহাদিগের সংস্পর্শে আসে নাই ইতিপূর্বে কোন মানুষ এবং না কোন জিন। (৫৫:৭৪) ব্যাখ্যাঃ- হুরের সঙ্গে মিলন লাভের পূর্ব পর্যন্ত কোন মানুষ অথবা জিন হুরকে স্পর্শ করার যোগ্যতা রাখে না। অর্থাৎ হুরের সংস্পর্শে আসিতে পারে না, বরং হুর গোপন কক্ষে আবদ্ধ এবং অজ্ঞতাই থাকিয় যায়। এই বাক্যটি ৫৬ নং বাক্যের শেষ অংশে উল্লেখিত আছে। রুহ জাগ্রত হইয়া দৃশ্যমান হইলে তাহাকে হুর বলে। হুরপ্রাপ্ত ব্যক্তির হুর অন্য সবার জন্য দৃশ্যমান নয়। সূফী সাধক কবি লালন শাহ্ রুহকে অচিন পাখী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। *তাঁহারা হেলান দেন সবুজ মূল্যবান বিছানার উপরে এবং সুন্দর গালিচার উপরে। (৫৫:৭৬) ব্যাখ্যা : সবুজ বিছানা অর্থে প্রশান্ত নির্মল এবং বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সমন্বিত মানবদেহ। তাঁহাদের দেহ এক একটি সবুজ বিছানা এবং তাঁহারা নির্ভরের হেলান দিয়া থাকেন আপন বিছানার উপরে এবং আপন দেহরূপ সুন্দর গালিচার উপরে। তাঁহাদের হেলান দেওয়া অর্থাৎ সকল প্রকার নির্ভর করা বিষয়টি আপন সুন্দর সালাতী দেহের উপরেই হইয়া থাকে। সালাতের সৌন্দর্যে তাঁহাদের দেহ অতি সুন্দর এবং স্বর্গীয় জ্ঞান ও সত্যের এলহামে ভরপুর। “সুন্দর গালিচা” বা সুন্দর মূল্যবান বিছানা। ইহা সালাতী মানবদেহের রূপক বর্ণনা। সালাত ব্যতীত মানুষের মধ্যে সৌন্দর্য বর্ধক কার্যকরী ব্যবস্থা আর কি হইতে পারে। মনের সকল অসৌন্দর্য মুছিয়া ফেলিবার উত্তম ব্যবস্থা হইল সালাত প্রক্রিয়া।