
সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাত ১০:৪৫
লোকসংগীতের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকার মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। শিল্পীর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। গত কিছু সপ্তাহ ধরে সপ্তাহে দু’দিন করে ডায়ালাইসিস চলছিল তাঁর। ২ সেপ্টেম্বর ডায়ালাইসিসের জন্য হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা অবনতি হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয় এবং পরে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। সবশেষে, চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে চিরবিদায় নিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।
সংগীতের সঙ্গে ৫৫ বছরের পথচলা
১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৬৮ সালে, রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর পেশাদার সংগীতজীবনের সূচনা। তবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি ও ভালোবাসা পেয়েছেন লালনগীতি গেয়ে। লালনের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বাণী তাঁর কণ্ঠে পেয়েছে প্রাণ, শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছেছে গভীরভাবে।
প্রথমদিকে নজরুল ও আধুনিক গান দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কুষ্টিয়ায় বসবাসের সময় এক হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের পরামর্শে লালনের গান শেখা শুরু করেন। তখন বাবা তাঁকে বলেন, ‘ভালো না লাগলে গাইবি না।’ এই শর্তে রাজি হয়ে তিনি লালনসংগীতের প্রবক্তা মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। প্রথম শেখা গান ছিল “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন”—এই গান দিয়েই শুরু হয় তাঁর নতুন সঙ্গীতযাত্রা।
স্মরণীয় মুহূর্ত
১৯৭৩ সালে ঢাকার বেতার স্টুডিওতে লালনের গান রেকর্ডের সময় একক ১৫ মিনিটের পরিবেশনা দিয়ে প্রশংসা কুড়ান সমর দাস, কমল দাশগুপ্ত, আবদুল হামিদ চৌধুরীর মতো বরেণ্যদের কাছ থেকে। সেটি তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষা ও তালিম
ফরিদা পারভীনের শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাবার চাকরির কারণে বারবার স্থানান্তরের ফলে তাঁর বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবনে এসেছে বৈচিত্র্য। স্কুলজীবন শুরু মাগুরায়, পরে কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। সংগীতে হাতেখড়ি ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে মাত্র ৪-৫ বছর বয়সে। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওস্তাদদের কাছে গান শিখেছেন।
লালনসংগীত শেখার পর মোকছেদ আলী সাঁইয়ের পাশাপাশি খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াসিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছ থেকেও তালিম নিয়েছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন
ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। তাঁদের সংসারে রয়েছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে—জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী ও চার সন্তান রেখে গেছেন।
অর্জন ও সম্মাননা
ফরিদা পারভীনের গাওয়া গান শুধু দেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বমঞ্চেও। তিনি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন, ডেনমার্কসহ বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন।
- ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন একুশে পদক
- ১৯৯৩ সালে সিনেমা ‘অন্ধ প্রেম’-এর “নিন্দার কাঁটা” গানটির জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
- ২০০৮ সালে পেয়েছেন জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার
জনপ্রিয় গান
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে যে গানগুলো মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে, তার মধ্যে রয়েছে—
- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
- বাড়ির কাছে আরশিনগর
- সত্য বল সুপথে চল
- তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম
- এই পদ্মা, এই মেঘনা
বিদায়ের ক্ষণে
ফরিদা পারভীন ছিলেন এক অনন্য সংগীতসাধক, যিনি লালনসাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ বাংলার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সংগীতের এক অধ্যায়ের ইতি ঘটল। তবে তাঁর কণ্ঠে ধারণ করা লালন দর্শন চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের স্মৃতিতে ও সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে।
শ্রদ্ধাঞ্জলি, ফরিদা পারভীন।
আপনার গান বেঁচে থাকবে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে।