
চলনবিলের বুকে আজ হঠাৎ আলোর ঝলক। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, আকাশে লাল আর কমলার আঁচড়ে যেন কারও ছবি আঁকার উন্মাদনা। বিলের পাশেই ছোট্ট গ্রাম—ঘাসিরবিল। গ্রামের ছেলে রিয়াদ প্রতিদিনের মতোই মাছ ধরার জাল গুছিয়ে বাড়ি ফিরছিল।
রিয়াদের সাথে আজ আছে আরেক সঙ্গী—একটি শাপলা ফুল। তার মনে হয় এই ফুলটির মধ্যে কোনো এক রহস্য লুকিয়ে আছে। ফুলটি সে তুলে এনেছিল দুপুরে, বিলের মাঝ বরাবর একটি ফোঁটা সবুজ দ্বীপ থেকে। দ্বীপটি গ্রামের লোকেরা বলে “ভাগ্যের চর,” যার কাছে যাবে, তার জীবনে নাকি পরিবর্তন আসে।
রিয়াদ এসব কথায় বিশ্বাস করে না, কিন্তু আজকের ঘটনা তাকে ভাবাচ্ছে। যখন সে ফুলটি তুলল, তখন পানির তলা থেকে যেন কারও ডাক এল। শব্দটা স্পষ্ট নয়, তবে মানবিক। সে ভীত হলেও কৌতূহল তাকে থামতে দিল না।
রাতে বাড়িতে পৌঁছে সে শাপলা ফুলটা পানিভর্তি পাত্রে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়—মৃদু আলো ফুলটিকে ঘিরে আছে। আলো থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে এক ক্ষুদ্রাকৃতি মেয়ে। তার চুলে শাপলার লালচে আভা, চোখে জলের গভীর রহস্য।
“আমি বিলপরী,” সে বলল।
“তুমি আমায় মুক্ত করেছ, তাই একটি সুযোগ তোমাকে দেব।”
রিয়াদ বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। পরী বলল, বিল বিপদের মুখে। পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, মাছ কমে যাচ্ছে, মানুষ অবহেলায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। পরী তাকে একটি দায়িত্ব দিল—চলনবিলকে রক্ষা করার দায়িত্ব।
“একটি প্রতিশ্রুতি দাও রিয়াদ।
বিলের জীবন রক্ষা করবে।
মানুষকে বলবে প্রকৃতি আমাদের মা।”
রিয়াদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। পরী তার হাতে একটি ছোট্ট মুক্তা দিল।
“যতদিন প্রতিশ্রুতি রাখবে, এই মুক্তা আলো দেবে।
ভুলে গেলে আলো নিভে যাবে, বিলও হারিয়ে যাবে।”
ভোরের আলো ফুটতেই পরী মিলিয়ে গেল, শাপলা ফুলটি আবার সাধারণ ফুল।
রিয়াদ হাতে মুক্তা শক্ত করে ধরল। তার চোখে দৃঢ়তা।
বিলের সঙ্গে তার সম্পর্ক বদলে গেছে।
এরপর থেকে রিয়াদ গ্রামের সবাইকে বলল—
বিলকে বাঁচাও, গাছ লাগাও, পানি বাঁচাও, মাছকে সময় দাও।
গ্রামের বাচ্চারা তাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।
বয়স্করাও ভাবল, এই ছেলেটা কি ঠিকই বলছে?
চলনবিলের জন্য এক বিপ্লব শুরু হয়ে গেল ধীরে ধীরে।
বছর ঘুরে গেল।
একদিন রাতের আকাশে জোনাকি নাচছে,
রিয়াদ দেখল—তার হাতের মুক্তা হঠাৎ আকাশের দিকে উড়ে গেল।
দূরে বিলের জলে আলো পড়ল।
বিলপরী ফিরে এসেছে, মুখে হাসি।
“তুমি প্রতিশ্রুতি রেখেছ, রিয়াদ।
চলনবিল বেঁচে গেছে।
তুমিও এই বিলে এক আলোকিত কিংবদন্তি হয়ে রইলে।”
চলনবিলের হাওয়া তখন গান গাইছে।
রিয়াদ সেদিন প্রথম বুঝল—
একটি ছোট সিদ্ধান্তও বদলে দিতে পারে পুরো পৃথিবী।