রবিবার, সকাল ১১:২৫, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার, সকাল ১১:২৫, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

#ছোট গল্প

যে পথে কমলিনী বাড়ি ফিরলেন

কেকা অধিকারী

এক

কাঠের দোতলা বাড়ির নড়বড়ে ঝুল বারান্দার মেঝেতে বসে আছি আমি একা। বারান্দার রেলিং-এর একটা পাশ খসে পড়েছে বেশ আগে। পাটাতনের ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর-কালো তক্তাগুলি যেন ক্ষয়িষ্ণু বাড়িটির বুকের এক্র-রে প্লেট। দুপুর গড়িয়ে সময়টা এখন বিকেলের দিকে। এখান থেকেই স্পষ্ট দেখছি পাশের বাড়ির সতুদা’র মা জেঠিমা রান্না ঘরের চুলার পাশে ছেঁড়া মাদুরে ক্লাšত শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। প্রায় বিশ বছর পর গ্রামে এসেছি। আত্মীয়-স্বজন, গাছ-গাছালি এমনকি সামনের পুকুর, যেটি আসলে রা¯তার ওপারের খালের একটি বাড়তি অংশ, সেটিও তার চেহারা পালটে ফেলেছে। চেনা যায় কি যায় না।

সে বার আমরা স্কুলের ছুটিতে গ্রামে এসেছিলাম। সেই দিনটিতেও রা¯তার ঐ কালভার্টটির উপরে একা বসেছিলাম আমি। এমনই এক পড়ন্ত দুপুরে। আমার ছোট ভাই আর বাড়ির ছোট ছোট খুড়তুতো ভাই-বোনগুলো নৌকা নিয়ে খালের জলে এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি ইচ্ছা করেই ওদের থেকে দূরে ছিলাম। পনের-ষোল বছরের মেয়েরা অমনই করে। তাদের একটু একা থাকতেই বেশি ভাল লাগে। ভালো লাগে ভীড় এড়িয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবতে। কালভার্টের উপর বসে থেকে আমি নীল আকাশ, উড়ে যাওয়া কিম্বা জমির আইলে বসে থাকা পাখি, ঘোলা জলের তিরতির ঢেউ, রঙ ছড়ানো লাল-কমলা কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুল ফুল দেখছিলাম। কী সুন্দর যে ছিল হিজল গাছের সারি! খালের দু’পাশে নুয়ে পড়া এ গাছগুলি জলের উপর লাল ফুলের লতা নামিয়ে দিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল, যেন তারা কোন গাছ নয়, এক একজন নার্শিসাস- নিজ রূপে মন্ত্রমুগ্ধ, স্থির, অচঞ্চল! আমি দু‘চোখ ভরে এ সবই দেখছিলাম। একই সাথে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে আমার উপর পথিকের কৌতুহলী চোখের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। জানতাম এভাবে এখানে বসে আছি শুনলে জ্যেঠামশায় আ¯ত রাখবেন না আমায়। তারপরেও একাকিত্ব উপভোগের মোহে আবিষ্ট আমি দু‘পা ঝুলিয়ে কালভার্টের উপর ঠাঁয় বসে রইলাম ।

ততোক্ষণে বৈঠা চালনার কৌশল আয়ত্ত করে ভাইটি আমার সদলবলে নৌকা বেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এমন সময় হঠাৎ নজরে এল ঘোলাটে সাদা থান পড়া এক নারীর আগমন। গ্রামের পথে সাদা শাড়ি গায়ে জড়ানো নারীর হেঁটে যাওয়া কোন অভিনব দৃশ্য নয়। বরং তার চেয়ে শতগুন বেশি অস্বাভাবিক ছিল আমার বয়সী একটা মেয়ের কালভার্টের উপর একা বসে থাকা। কিন্তু দৃশ্যটা সত্যিই অন্য রকম ছিল। মহিলা হাঁটছিলেন শরীরটা ডান দিকে বেঁকিয়ে, দু’হাত দিয়ে বা’কাঁখে একটি ধামা জাপটে ধরে। তার পথচলা বলে দিচ্ছিল ধামা ভর্তি আছে ভারী কোন বস্তুতে। ছোট ছোট কদমে সোজা রা¯তা দিয়ে বাঁকা শরীরটি প্রচন্ড ক্ষীপ্ততায় এগিয়ে আসছিল। কিছুটা কাছে এলে দেখলাম চুল তার ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা আর গলায় তুলসীর মালা। ‘কত্তো দূর থেকে না জানি আসছেন উনি! আচ্ছা এতো ভারী বোঝা নিয়ে কতদূর হাঁটা যায়?’ সেদিন নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রায় নির্জন রা¯তার উপর দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে – বিষয়টা মহিলারও দৃষ্টি কেড়েছিল। কাছে আসতে তিনি চলার গতি কমিয়ে দিলেন, যেন জানতেন মেয়েটি তার সাথে কথা বলবে। পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম আমি।

‘কোথা থেকে আসছেন আপনি? মানে আপনার বাড়ি কোথায়? ’

তার উত্তর বোধগম্য হল না আমার। হয়তো গলার স্বর মৃদু ছিল, অথবা স্থানটির নামের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম খালের সমাšতরাল রা¯তাটি যেখানে দৃষ্টির সীমানা ছুঁয়েছে তারও ওপারে কোথাও তার ঠিকানা।

‘এখন যাবেন কোথায়?’

‘বাপের বাড়ি।’

উনি ইঙ্গিতে সামনের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। এবারও তার গন্তব্য আমার কাছে স্পষ্ট হল না।

বেতের ধামাটির দিকে তাকিয়ে অবাক আমি – বাবার বাড়িতে এমন করে কেউ চাল নিয়ে যায়, তা আবার এতো কষ্ট করে!

মহিলার গায়ের রঙ কোন কালে ফর্সাই ছিল, কিন্তু আজ তা তার সাদা শাড়ির মতো মলিন, সেখানে রঙের বড় অভাব। মুখ আর গলার বলিরেখাগুলি ত্বকের বিবর্ণ ক্যানভাসে যেন পেন্সিলের আঁচড়। তিনি আমায় কোন প্রশ্ন করলেন না, উত্তরেও বাড়তি কথা বললেন না। তবুও আমরা পাশাপাশি আপন জনের মতো হেঁটেছিলাম খানিকটা পথ। ভারবাহী ক্লান্ত ন্যুজ প্রৌঢ়ার পাশে ঝাড়া হাত-পা সটান হাঁটতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল আমার।

ভালোমানুষি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে বলেছিলাম, ‘দ্যান আপনার ধামাটা, আমি কিছুটা এগিয়ে দেই।’

বিনা বাক্যে তিনি সেটা এগিয়ে দিলেন। আমার ভুল ভাঙল। নবীন বয়স, চকচকে মসৃণ ত্বক, পুষ্ট ঋজু দেহ-ও এবার লজ্জা পেল। ধামার ভার আমার ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। বুঝি তার জীবনের ভারও ছিল ঐ রকম জগদ্দল পাথরের মতো। ধামা কাঁেখ আমার শরীর তার চেয়েও বেশি বেঁকে গিয়ে কিম্ভূত আকার ধারণ করেছিল নিশ্চয়। সে দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না প্রৌঢ়া। কিছুটা পথ যেতে টেনে নিলেন ধামাটি। তার মায়াময় চাহনী আমার অক্ষমতার লজ্জাকে ঢেকে দিল। আমি তার সঙ্গ ছাড়লাম না। কিছুটা এগোতে পৌঁছে গেলাম আমাদের গ্রামে ঢোকার কাঠের পুলটির কাছে। তিনি বললেন, ‘এবার বাড়ি যাও’। তার কথা অমান্য করার শক্তি আমার ছিল না। বলতে পারলাম না, ‘পাশাপাশি হাঁটতে আমার ভাল লাগছে। আরেকটু আসি আপনার সাথে?’ দু’এক পা হেঁটে আমি থেমে পড়লাম। তার ক্ষনিক দৃষ্টি আরেকটিবার আমাকে ভালোবাসায় বিদায় সম্ভাষণ জানাল। পরক্ষণেই একবারের জন্যেও পিছনে না ফিরে এগিয়ে চললেন তিনি। আমি চেয়ে রইলাম তার চলার পথের দিকে। আমার অন্তর চলল তার সাথে তার গন্তব্যে। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে বিষন্ন মনে আমি বাড়ি ফিরলাম। নিরবে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম একা। বসেছিলাম এই বারান্দায়। তখনো সন্ধ্যা নামতে ঢের বাকী।

কী আশ্চর্য! বিশ বছর পরেও সেই প্রৌঢ়া আমার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যান! কিন্তু মিলিয়ে যান না কোথায়ও বরং আজও আমি তাকে খুঁজে পাই আমার হৃদয়ে, ম¯িতস্কের কোষে।

দুই

এ বাড়ির জৌলুসকালে এখানে আরেকজন নারী ছিলেন যিনি আমার আরো গভীরে রয়ে গেছেন কিম্বা আছেন আমার দেহের প্রতিটি কোষে মিশে। শৈশবে বুঝতে শেখার সময়ে তিনিও ছিলেন বয়সে প্রৌঢ়া। আমি তাকে জেনেছি আমার কৈশোরে, সেই এগারো-বারো বছর বয়সে, ততোদিনে তিনি বৃদ্ধা। সুশ্রী, সুন্দর এক ব্যক্তিত্বময়ী নারী। সেই ঘোলাটে সাদা শাড়ির প্রৌঢ়ার মতো এই সুশ্রী বৃদ্ধার জীবনের শুরুটাও আমি জানতে পারি নি। কিন্তু আমি সত্যিই জানতে চাইতাম ওই ঈর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী নারীর বাবার বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এলেন তিনি। কেননা চারপাশের আর কারো তার মতো সৌন্দর্য ছিলনা, আর কেউ তার মতো ছিল না।

একদিন জানতে চেয়েছিলাম ‘আচ্ছা, তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার ভাই-বোন আছে?’ তার চোখ হঠাৎ বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কি যেন খুঁজল সেই দু’টি চোখ। তারপর এক সময় দৃষ্টি স্থির হল তার। সেই স্থির দৃষ্টি উদাস করে দিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন,

‘আমি তো ‘জলে ভাসা পদ্ম’, ¯্রােতে ভাসা কচুরিপানা। কনভেন্টে বড় হয়েছি আমি।’

‘কনভেন্ট কী?’

‘ঐ যে যেখানে ক্যাথলিক সিস্টারেরা থাকেন। সেখানে তাদের অরফানেজে আরো অনেক অনাথ ছেলে-মেয়ের সাথে থেকেছি।’

‘কোথায় সেটা?’

‘কলকাতায়।’

‘কেন? তোমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ ছিল না?’

‘ছিল হয় তো।’

‘তুমি তাদের দেখ নি কোনদিন?

‘না।’

‘জানতে চাও নি তাদের কথা?’

‘অনেক চেয়েছি।’

‘কিচ্ছু জানতে পার নি?’

‘কিছুটা পেরেছি। কনভেন্টের সিস্টাররা আমাকে বলেছেন জন্মের সময় মা মরে যাওয়ায় নাকি আমার বাবা আমাকে ওখানে রেখে যান ওতোটুকু বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবেন না তো তাই।’

‘তোমার বাবা পরে আর কখনো তোমাকে দেখতে আসেন নি?’

‘জানি না, তাকে তো কোনদিন দেখিনি।’

শুনে আমার ছোট্ট বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। আমার বিষ্মিত ঝাপ্সা চোখ দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘ওখানে বাচ্চা দিলে চিরদিনের জন্যে দিতে হয়। ফেরত নেয়া যায় না।’

‘আর কিছু বলে নি সিস্টাররা তোমাকে?’

‘বলেছেন।’

‘কী?’

‘আমার বাবা পটুয়াখালীর জমিদার ছিলেন।’

‘তোমার কখনো বাবা-মা, ভাই-বোনদের কাছে যেতে ইচ্ছা হয় নি?’

‘কোলকাতা থেকে পটুয়াখালি তো অনেক দূর।…. কতোই বা বয়স ছিল তখন আমার!’

‘তাহলে তুমি আমাদের বাড়িতে এলে কী করে?’

‘এক ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে কোলকাতায় এসে আমার শ্বশুরমশায় আমাকে দেখেছিলেন। তিনিই আমাকে পছন্দ করেন তার বড় ছেলের জন্যে। কালো ছেলের জন্যে সুন্দর বৌ চেয়েছিলেন তিনি।’

‘বরিশাল তো পটুয়াখালির খুব কাছে। তুমি তোমার বাবার খোঁজ কর নি কখনো?’

‘না।’

‘কেন? ইচ্ছা করে নি তোমার তাদের দেখতে?’

‘সব সময়ই করেছে। কিন্তু আর কিছু জানা ছিল না যে! তাছাড়া এ বাড়িতে কেউ তো কোনদিন তাদের কথা বলে নি, জানতেও চায় নি। তারা আমাকে ‘অরফান’ বলতেই বেশি ভালোবাসতো। আর বললেই বা কে নিয়ে যেত আমাকে?’

তার কথায় কি যেন কী ছিল, ছোট্ট আমার ভেতরটা ‘দুয়োরাণী’র গল্প শুনে যেমন করতো তেমন করে উঠেছিল। বুজে এসেছিল গলা। ঢোক গিলে কষ্টের দলাটাকে পেটে চালান দিয়ে অনেক চেষ্টায় বলতে পেরেছিলাম ‘আমি আরেকটু বড় হয়ে তোমাকে পটুয়াখালিতে নিয়ে যাব। খুঁজে বের করবো তোমার বাড়ি, ভাই বোনদেরকে।’

বিষন্ন বৃদ্ধা আমার কথায় হেসে ফেলেছিলেন। তার সে ম্লান হাসির সাথে যেন মিশে ছিল সারা জীবনের বিদ্রুপ আর শ্লেষ। বুঝেছিলাম আমার কথায় তিনি আস্থা রাখতে পারেন নি। অপমানিত আমি আমার কথাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে যুক্তি দিয়েছিলাম ‘কোলকাতার কনভেন্টে নিশ্চয়ই তোমার বাবার ঠিকানা লেখা আছে। ওখানের ফাদার-সিস্টারদেরকে চিঠি দিলে নিশ্চয়ই ওনারা তোমার বাবার ঠিকানা দেবেন। সেটা নিয়ে তোমার বাড়ি খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন হবে না। বুঝেছো?’

আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘জানো. কনভেন্টে কোন বন্ধুর সাথে আড়ি হলে আমরা তাকে রাগাতে অন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে গাইতাম – ‘তোমারই নাম বলব, আমি বলবো নানা ছলে। তোমারই নাম বলব . . . . .।’ আবার যখন তার সাথে ভাব হতো তখন সবাই মিলে দল বেঁধে গাইতাম, ‘আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি, ধরি, নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।…” আমার হাত দু’টি নিজের হাতে নিয়ে তিনি গান গাইতে শুরু করলেন। তবে তার সুর কেমন যেন কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল। সে কাঁপন কতোটা কষ্ট লুকাতে, কতোটা আমার অভিমান ভাঙাতে আর কতোটা নিজের কৈশোর খুঁজে পাবার আনন্দে ছিল আমি তা ধরতে পারি নি। কিন্তু সেই গান, সেই সুর আমার মনে স্থায়ী হয়েছে।

সেদিনের পর থেকে তিনি আমার অনেক কাছের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন হয়েছিলাম আমি তার। আমাদের সম্পর্ককে অটুট রেখে বৃদ্ধা এরপর আরো অনেক বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সে বছরগুলিতেও তার শেকড়ের খোঁজ এনে দেয়ার মতো বড় হয়ে উঠতে পারি নি আমি।

তিনি গত হয়েছেন সেই কবে, কত বছর আগে! এখন সে ঠিকানা খোঁজা অর্থহীন। তবুও প্রায়ই আমি আমার স্বপ্নে পটুয়াখালির জমিদার বাড়ির সন্ধান করি। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যাই। জমিদার বাড়ির সিংহ দরজা পেরিয়ে আমি অšতঃপুরে প্রবেশ করি। জমিদার পরিবারের বংশ-লতিকা, কোষ্ঠি, আত্মীয়-স্বজন, তাদের বর্তমান অবস্থান সব জেনে ফেলি। খুশিতে আমি এক দৌঁড়ে বৃদ্ধার কাছে ছুটে যেতে চাই। জানাতে চাই তার জন্ম-কথা, জীবন-বৃত্তাšত – বাবার নাম, মায়ের নাম, ভাই-বোনের সংখ্যা, স্থায়ী নিবাস। সব কিছু। মাঠ, প্রাšতর, ধান ক্ষেত পেরিয়ে আমি ছুটতে থাকি। স্বপ্নের ভেতরেই আচমকা একটি প্রবল জলস্্েরাত আমার গতি রোধ করে। দূর্বল, অবসন্ন, উত্তেজনায় কাঁপা দু’টি পায়ে বাঁশের সাঁকো পেরোতে গিয়ে নিচের জলে টুপ করে পড়ে যাই আমি। তারপর ভেসে যেতে থাকি প্রবল ¯্রােতের টানে। ডাঙায় ফেরা হয় না আমার বহুদিন, বৃদ্ধার কাছেও আর যাওয়া হয় না। জানানো হয় না তাকে তার জন্মের ইতিহাস। আমি শুধু ভেসে যাই, তবু কেন যেন ইতিহাস জানানোর ইচ্ছাটুকু আমাকে ছেড়ে যায় না কোথায়ও।

তিন

সে দিন আমি দ্বিতীয় বারের মতো পুরান ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটির হোমে এসেছিলাম। জানা ছিল খ্রিস্টান ফাদার, সিস্টারেরা একটু কড়া ধাঁচের হন। টেলিফোনে কথা বলে আর প্রথম বার এসে সে অভিজ্ঞতা করেছি আমি। তবে আজ বড্ড বেশি রুক্ষ মনে হলো তাদের ব্যবহার। ‘দিদি, সিস্টারের কথায় কষ্ট পাবেন না। ওনারা টেস্ট করেন আপনার বাচ্চা নেবার আগ্রহ কতোটা।’ সহকর্মী মার্টিনের কথায় আমি যুক্তি খুঁজে পেলাম। মার্টিনেরও বাচ্চা ছিল না। পরে ওরা স্বামী-স্ত্রী মাদার তেরেজার এই হোম থেকে বাচ্চা নিয়েছে। অনেক বড় বড় মানুষকে ধরেও যখন কাজ হলো না, তখন আমি আমাদের অফিসের পিওন, এই সাধারণ মানুষটির অসাধারণ ক্ষমতার হদিস পেয়েছি। সত্যিই কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে। যাক্, এখানে আসার কারণটা এবার বলি।

এ্যানি আমার মেঝ কাকার ছোট মেয়ে। আমেরিকায় থাকে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের এগারো বছর পার হলেও সন্তানের মুখ দেখতে পায় নি ওরা। এখন আমার সহায়তা চাইছে। আমাকেই বলেছে বাচ্চা খুঁজে নিয়ে আইনী প্রক্রিয়া শুরু করতে। বাকীটা ও ওর স্বামী শিশিরকে নিয়ে দেশে এসে করবে। প্রায় প্রতিদিনই ফোন, ই-মেইল কিম্বা স্কাইপে ওদের সাথে আমার যোগাযোগ হচ্ছে।

প্রথম দিন হোমে এলে নিচতলার বারান্দায় চার পাঁচজন সন্তানসম্ভবা কিশোরীকে দেখেছিলাম। প্রথম সন্তানকে সিস্টারদের হাতে তুলে দিয়ে ভুল-জীবনকে পিছনে ফেলে নতুন জীবন শুরু করবে ওরা। হয়তো ওদের ভুলগুলি নিঃসন্তান পরিবারে ফুল ফোটাবে। এক, দুই, তিন, চার . . . . .। একটি রুমে আলাদা করে রাখা হয়েছে কয়েক মাস থেকে ৪/৫ বছরের সাত জন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুকে। বিছানায় শুয়ে থাকা শিশুগুলোর কারো হাত আছে, আঙ্গুল নেই। কারো বা পায়ের আঙ্গুলগুলো নেই। কারো কারো আবার হাত-পা দু’টোই ঠিকমতো নেই। কারো আছে অন্য ধরণের প্রতিবন্ধীতা। কামুক আর হিং¯্র সমাজের এমআর প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেঁচে গেছে ঐ অনাকাঙ্খিত শিশুরা। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কি করে বেঁচে থাকবে ওরা? একটি দৃশ্য আমাকে আশ্বস্ত করলো – পোল্যান্ডের একজন সুশ্রী তরুণী সিস্টার পরম মমতায় এই শিশুদের পরিচর্যা করছেন। পাশের রূমে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু আছে বেশ কয়েকজন। এ সব শারীরিক কিম্বা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে কারো কাছে দত্তক দেয়া হবে না, হোমের সিস্টারেরা নিজেরাই এদেরকে যতœ ও ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রাখবেন।

প্রাথমিক কথা-বার্তার পর সিস্টার-ইন-চার্জ নিজে আমাকে বাচ্চা দেখাতে নিয়ে গেলেন। ধর্ম, বয়স ইত্যাদি বিধি নিষেধ মেনে যে কয়টি বাচ্চাকে তিনি দেখালেন তার মধ্যে একটি বাচ্চার মুখ আমার মন কেড়ে নিল। আড়াই মাস বয়সী মেয়েশিশু – ফর্সা গোল মুখ, কালো চোখের মনি আর ঘন কালো চুলে ঢাকা ছোট্ট কপাল! মনে হলো এই চেনা মুখটিকেই তো আমি বহুদিন থেকে খুঁজছি। দু’হাত বাড়িয়ে বেবিকট থেকে শিশুটিকে কোলে তুলে নিতেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সিস্টারের রুক্ষ স্বর, ‘উঁহু, একে তো আপনাদের দেওয়া যাবে না। ওর বিষয়ে আরেক কাপলের সাথে কথা হয়েছে। তারা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আগামী মাসে আসছেন।’ শুনেছিলাম আগ্রহী দম্পতিদের সাথে বাচ্চার গায়ের রঙ, চেহারা ইত্যাদির মিল দেখে নাকি সিস্টাররা বাচ্চা দত্তক দেন। ছোট্ট মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘না, না, সিস্টার। আমাদের ওকেই দিতে হবে। ওকেই দিতে হবে। এ্যানি, মানে ওকে যে নেবে সে কিন্তু অনেক ফর্সা, আমার মতো না। তাছাড়া আমরাও তো সেই কবে থেকে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি। আমার কাজিনও বাচ্চা নিতে শীঘ্রিই দেশে আসবে। আজই আমি ওর কথা তাদেরকে জানাবো।’

পুরান ঢাকার মাদার তেরেজার হোমে আমার যাতায়াত বেড়ে গেল। ইতোমধ্যে সিস্টারের সাথে এ্যানি-শিশিরের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। পদ্মর বেশ কিছু ছবি আমি ওদেরকে পাঠিয়েছি। আর হ্যাঁ, ‘পদ্ম’ নামটি আমারই দেয়া। এ্যানি-শিশির আমার অনুরোধ ফেলেনি, ডাকনাম হিসেবে এ নামটিকেই মেনে নিয়েছে।

প্রতি সপ্তায় আমি পদ্মকে দেখতে যাই। কি করবো? না গিয়ে থাকতে পারি না। ওকে কোলে নিয়ে অনেক ক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর গায়ের ঘ্রান নেই। ওকে ফিডারে দুধ খাওয়াই, কাপড় বদলে দেই। গায়ে লোশন মাখাই। বেশ বুঝতে পারি এমন আলো করা শিশু আমার কোলে মানায় না, ঠিক যেমন আমাকে মানাতো না সেই উজ্জ্বল শুভ্র বৃদ্ধার পাশে কিম্বা কোলে। তবুও শিশুটিকে আমার বড় আপন বলে মনে হয়, যেমন হতো সেই বৃদ্ধাকে।

এক সময় এ্যানি আর শিশির দেশে এলো। মাদার তেরাজার হোম থেকে ওদের সাথে পদ্ম এলো আমার ঘরে। আইনি কাজ অনেকটা গুছিয়ে এক মাস পরেই শিশির আমেরিকা ফিরে গেল। বাচ্চা সাথে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে যেতে উদগ্রীব এ্যানির প্রতিদিনকার আক্ষেপ ‘এ দেশের রাস্তায় এতো এতো বাচ্চা পড়ে থাকে, না খেয়ে থাকে, ভিক্ষা করে, অথচ একটা বাচ্চা লিগ্যালি নিতে নিয়ম-কানুনের শেষ নাই!’ মেয়েকে নিয়ে কত্ত যে পরিকল্পনা ওর! ফিরে গিয়েই মেয়ের জন্যে একটা বড় সড় পার্টি দেবে ঘরে। পদ্মকে আমেরিকা নেয়ার সব ফর্মালিটি শেষ করতে সাত মাস পেরিয়ে গেল। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে যেতে শিশির আবার দেশে এলো।

চার

এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন গেটের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে। পদ্ম আমার কোলে। পাশে এ্যানি ও শিশির। পদ্মকে আমি শিশিরের কোলে দিলাম ‘যাও, নিজের ঠিকানায় যাও। বাবা-মায়ের সাথে থাকো’ বলে গালটা ছুঁয়ে দিতেই দশ মাসের পদ্ম আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। পদ্মকে বুকে এবং এ্যানিকে পাশে নিয়ে শিশির গেটটি অতিক্রম করলে এক সময় আমি আর ওদেরকে দেখতে পেলাম না। চোখ ভিজে গেছে। কিন্তু পদ্মর জন্য আমার বুকটা যতোটা হু হু করার কথা, ততোটা করছে না তো! তার বদলে মনে এক অনাবিল প্রশান্তি ভর করেছে। ধীর পায়ে গাড়ীতে এসে বসলাম আমি। সীটে মাথা এলিয়ে দিতে আপনাতেই আমার দু’চোখ বন্ধ হল। আমি এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করলাম। সুদূর অতীত থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন কনভেন্টে বড় হওয়া শ্বেত-শুভ্র সম্ভ্রান্ত সেই বৃদ্ধা। আমি তাকে বললাম, ‘‘দেখেছো মিসেস কমলিনী সরকার, আমি তোমার বাবা-মাকে ঠিকই খুঁজে বের করেছি। তুমি আর ‘জলে ভাসা পদ্ম’ নও, তুমি এখনও পদ্ম তবে স্থলপদ্ম। যথারীতি মাটির গভীরে শেকড় আছে তোমার। কি এবার খুশি তো?’’ বৃদ্ধার চোখে আনন্দাশ্রু আর মুখে তার পদ্মর বিদায় বেলার স্মিত হাসি।

চোখ বুজেই রইলাম আমি। অবসন্ন অথচ পরিতৃপ্ত, পরিশ্রান্ত অথচ ভারমুক্ত। মনে হচ্ছে যেন আমি ভেসে যেতে যেতে ডুবে যাই নি, তীরে উঠেছি। যেন এইমাত্র গ্রামের পথে হেঁটে যাওয়া সেই ধামাবাহী বৃদ্ধার সাথে আমার কাঙ্খিত দীর্ঘ পদযাত্রা শেষ হল। অবশেষে যেন আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছলাম।

পাঁচ

জীবনের সূচনা না জানা কমলিনী সরকার আমারই পিতা-মহী ছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top