রবিবার, সকাল ৮:০১, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার, সকাল ৮:০১, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বয়সী বাবাদের শুক্রাণু কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

অধ্যাপক সাইফুদ্দিন একরাম

(তিনি একজন ক্লিনিক্যাল গবেষক এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞResearchGate+1

তাঁর গবেষণার মূল ফোকাস হলো বৃদ্ধত্ব (aging), দুর্বলতা (frailty), এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ (chronic diseases) সম্পর্কিত বিষয়। ResearchGate+1

তিনি Monash University, Australia এ Adjunct Research Fellow হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। ResearchGate+1

পূর্বে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ-এ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। ResearchGate+2SciSpa)

বয়সী বাবাদের শুক্রাণু কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

পিতৃত্বের বয়সের সঙ্গেও সন্তানের জেনেটিক ভবিষ্যৎ জড়িয়ে রয়েছে। আমরা বয়স বাড়াকে সাধারণত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে দেখি। কিন্তু জীববিজ্ঞানের চোখে বয়স কেবল প্রজ্ঞার গল্প নয় — এটি জেনেটিক পরিবর্তনের গল্পও। আর এই গল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল পুরুষের বয়স এবং তার শুক্রাণুর মান।

সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমাদের এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেঃ পুরুষের বয়স যত বাড়ে, শুক্রাণু তত বেশি জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশনের ভার বহন করে। আর এই পরিবর্তনগুলো অনেক সময় হয়ে ওঠে “স্বার্থপর” — নিজেদের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে সন্তানের জেনেটিক ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে।

বয়স ও শুক্রাণুর জেনেটিক পরিবর্তনের অদৃশ্য গল্প

পুরুষদের শরীরে শুক্রাণু তৈরির প্রক্রিয়া (spermatogenesis) সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। কৈশোরে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়া বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত থামে না। কিন্তু এই অবিরাম যাত্রার একটি জৈবিক মূল্য আছে।

প্রতিটি শুক্রাণু তৈরির সময় কোষ বিভাজন ঘটে — আর প্রতিটি বিভাজন মানে সামান্য জেনেটিক ভুল বা মিউটেশন হওয়ার সুযোগ। তরুণ বয়সে বিভাজনের সংখ্যা কম থাকায় মিউটেশনও কম হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভাজনের সংখ্যা বেড়ে যায়, ফলে ভুলের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় বহুগুণে।

গবেষণা বলছে, একজন ২০ বছর বয়সের একজন পুরুষের শুক্রাণুতে গড়ে প্রায় ২০–২৫টি নতুন মিউটেশন থাকে, কিন্তু ৪০ বছরের একজন পুরুষের শুক্রাণুতে সেই সংখ্যা হতে পারে ৬০–৭০-এর বেশি (Kong et al., Nature, 2012)। এই নতুন মিউটেশনগুলোর বৈশিষ্ট্য সন্তানেও স্থানান্তরিত হতে পারে, এবং ভবিষ্যতে রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

“স্বার্থপর” মিউটেশন – প্রতিযোগিতার অন্ধকার দিক

“স্বার্থপর” শব্দটি শুনতে যেন মানুষের আচরণের মতো শোনায়, কিন্তু এই ক্ষেত্রে এর অর্থ একেবারে নির্দিষ্ট। কিছু মিউটেশন শুক্রাণুকে এমনভাবে বদলে দেয় যে তারা অন্য শুক্রাণুর চেয়ে বেশি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলনের সম্ভাবনা বাড়ায়।

এখানে সমস্যা হলো — এই ‘বিজয়ী’ শুক্রাণু অনেক সময় ক্ষতিকর জিন বহন করে। তারা নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যের সঙ্গে আপস করে ফেলে।

এই ধরনের মিউটেশন অনেক গুরুতর রোগের সঙ্গে যুক্তঃ

– অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারঃ পিতার বয়স ৪০-এর বেশি হলে সন্তানের অটিজমের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায় (Reichenberg et al., 2006)।

– স্কিজোফ্রেনিয়া ও মানসিক রোগঃ বয়সী পিতার সন্তানদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।

– বিরল জেনেটিক রোগঃ FGFR2 এবং FGFR3 জিনে স্বার্থপর মিউটেশনের কারণে অ্যাকন্ড্রোপ্লাসিয়া (বামনত্ব) এবং ক্র্যানিওসাইনোস্টোসিসের মতো বিরল রোগ দেখা যেতে পারে।

অর্থাৎ, এই “চালাক” শুক্রাণুগুলো প্রতিযোগিতায় জিতে গেলেও, সেই জয়ের খেসারত দিতে হয় সন্তানের জেনেটিক স্বাস্থ্যে।

গবেষণার সর্বশেষ প্রমাণ

New Scientist–এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে (Le Page, 2025) বিজ্ঞানীরা শুক্রাণুর জিনোম সিকোয়েন্সিং করে আবার দেখেছেন, বয়সী পুরুষদের শুক্রাণুতে “স্বার্থপর” মিউটেশন বহনকারী কোষের সংখ্যা তরুণদের তুলনায় অনেক বেশি।

এই কোষগুলোঃ

– নিজেদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় এবং সুস্থ কোষগুলোকে পিছিয়ে ফেলে।

– ক্ষতিকর জেনেটিক পরিবর্তন ডিম্বাণুতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা বাড়ায়।

– তরুণ বাবাদের তুলনায় ২–৩ গুণ বেশি মিউটেশন সন্তানের জিনে স্থানান্তর করে।

এটি এক নীরব প্রক্রিয়া — শরীরে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, কিন্তু প্রভাব পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যে।

পিতার বয়স ও সন্তানের স্বাস্থ্যঃ অজানা সম্পর্ক

আমরা সাধারণত মাতৃত্বের বয়স ও ডিম্বাণুর গুণমান নিয়ে বেশি আলোচনা করি। কিন্তু এখন গবেষণা বলছে — পিতার বয়সও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

– ৪০ বছর বয়সে পিতৃত্ব নেওয়া পুরুষদের সন্তানের অটিজম ঝুঁকি ২০ বছর বয়সীদের তুলনায় প্রায় ৬ গুণ বেশি হতে পারে।

– মানসিক রোগ, বিকাশে বিলম্ব, এমনকি শেখার সমস্যার ঝুঁকিও বাড়ে।

– কিছু বিরল জেনেটিক রোগের ঝুঁকি ৮–১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

এই তথ্যগুলো আতঙ্কের জন্য নয় — বরং সচেতনতার জন্য। সন্তান পরিকল্পনার সময় কেবল মায়ের বয়স নয়, বাবার বয়স ও স্বাস্থ্যের বিষয়েও সমান মনোযোগ দেওয়া উচিত।

ঝুঁকি কমানোর উপায়

যদিও বয়স থামানো যায় না, কিছু পদক্ষেপ এই জেনেটিক ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারেঃ

– পরিবার পরিকল্পনায় বয়সকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করুন।

– স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন — অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে ডিএনএ ক্ষতি কমানো সম্ভব।

– জেনেটিক কাউন্সেলিংয়ের সাহায্যে ঝুঁকি মূল্যায়ন করুন, বিশেষ করে বয়স বেশি হলে।

– ভবিষ্যতে শুক্রাণুর জিনোম বিশ্লেষণের মতো প্রযুক্তি হয়তো সন্তান পরিকল্পনার আগে আরও স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারবে।

বয়স শুধু সংখ্যা নয়, জিনের গল্পও

এই নতুন গবেষণা আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছেঃ বয়স কেবল ক্যালেন্ডারের পাতা নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জেনেটিক নকশার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

পিতৃত্বের বয়স শুধুই অভিজ্ঞতা ও দায়িত্বের প্রতীক নয়, এটি সন্তানের সুস্থতার ভিত্তিও গড়ে দেয়। তাই পরিবার পরিকল্পনায় পিতা ও মাতার বয়স — উভয়ই বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

একটি সুস্থ প্রজন্ম শুরু হয় আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত থেকে। এবং সেই সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে থাকা উচিত কেবল বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top