
দেশের স্বাস্থ্য খাতে চলছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পদোন্নতির প্রক্রিয়া—প্রায় ৭,৫০০ চিকিৎসক পাচ্ছেন সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি। তবে এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)–এর বহু সদস্য। অনেকেই অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পরও ৭ জন চিকিৎসকের পদোন্নতি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাঁদের কাছে এ সিদ্ধান্ত অন্যায় মনে হলেও, মন্ত্রণালয়ের দাবি—ওটা ছিল “ভুল পদোন্নতি”।
রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপ ছিল স্বাস্থ্য খাতের প্রভাবশালী সংগঠন। সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তাদের সদস্যরা।
কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এই চিত্র উল্টে যায়। নতুন প্রশাসন আসার পর স্বাচিপ–সদস্যদের অনেককে বদলি, ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
বর্তমানে ড্যাব (ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) ও এনডিএফ (ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম)–এর সদস্যরা পদোন্নতিতে সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে দুই সংগঠনের নেতারা বলছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।
পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকদের অভিযোগ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন ৭৬৮ জন, আর বঞ্চিত হয়েছেন ১৩০ জন, যাঁদের অধিকাংশ স্বাচিপ–সদস্য।
গাইনি বিভাগে ৫৯২ জন পদোন্নতি পেলেও ২৮৫ জন বাদ পড়েছেন। কলোরেক্টাল সার্জারি, নাক–কান–গলা, নেফ্রোলজি, থোরাসিক সার্জারি, দন্তরোগসহ আরও কয়েকটি বিষয়েও একই অভিযোগ।
এক নারী চিকিৎসক বলেন,
“আমার ছাত্রীকে পদোন্নতি দিয়ে আমার ওপর বসানো হয়েছে। আমি লজ্জায় কলেজে যেতে পারছি না, বাসাতেও মুখ দেখাতে পারছি না।”
অন্যদিকে, কেউ কেউ অভিযোগ করছেন যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে জোরপূর্বক তাঁদের স্বাচিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল—এখন সেই পরিচয়ের কারণেই তাঁরা বঞ্চিত।
সুপারনিউমারারি পদোন্নতি কী?
যে পদে শূন্যপদ অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু যোগ্য প্রার্থী বেশি—তখন অতিরিক্ত পদ তৈরি করে পদোন্নতি দেওয়াকে বলা হয় সুপারনিউমারারি পদোন্নতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর বলেন,
“৮২টি বিষয়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে—এত বড় পরিসরে একসঙ্গে পদোন্নতির নজির বাংলাদেশে নেই।”
সাতজনের পদোন্নতি বাতিলের ঘটনা
২২ অক্টোবর গাইনি অ্যান্ড অবস্ বিষয়ে ৫৯৯ জন চিকিৎসকের পদোন্নতি ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু একদিন পরই ৭ জনের পদোন্নতি বাতিল করা হয় কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই।
বাতিল হওয়া চিকিৎসকদের একজন বলেন,
“আমরা নিজেরা আবেদন করিনি, অথচ যোগ্য হয়েও হঠাৎ পদোন্নতি দেওয়া হলো, আবার পরের দিন বাতিল—এতে আমরা সামাজিকভাবে বিব্রত।”
স্বাস্থ্যসচিব মো. সাঈদুর রহমান বলেন,
“ওই সাতজনকে ভুল করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।”
মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
স্বাস্থ্যসচিবের দাবি,
“কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সেগুলো তদন্তাধীন। যাঁদের মনে হয় অন্যায়ভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি, তাঁরা অভিযোগ জানাতে পারেন। প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।”
তবে স্বাস্থ্যখাতের অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকরা বলছেন—
রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি বা বঞ্চনা চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।